কেন উদ্যোক্তা হবেন? Entrepreneur হলে কী কী ক্ষতি হবে?
বর্তমানে তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা খুব বেশি লক্ষ্য করা যায়। তবে আগে আপনাকে জানতে হবে কেন উদ্যোক্তা হবেন? উদ্যোক্তা হলে লাভ ও ক্ষতি কী কী?
আমাদের দেশে একসময় প্রত্যেক শিক্ষিত বাবা-মা তার সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে বলতেন। সেভাবে ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করতো। ভার্সিটি পরীক্ষায় তুমুল প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ কেউ সুযোগ পেতেন। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তো পড়া-লেখায়। এদিকে তার স্বপ্নের বা প্যাশনের বারোটা বেজে এখন তেরোটা। যারা পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেতেন না, তাদের ধনী বাবা বেসরকারী মেডিকেল বা ভার্সিটিতে ভর্তি করে যুদ্ধজয়ের শান্তি পেতেন।
সময় কথা বলে। সময় বদলে যায় (আসলেই সময় বদলে যায় না, একদিনে ২৪ ঘণ্টার স্থলে ২৫ ঘণ্টা হয় না, সবসময়ই ৬০ সেকেন্ডে ১ মিনিট। কষ্টের সময় বলেন আর আনন্দের সময় বলেন, সবসময়ই সময় সময়ের নিয়মে ঝরা পাতার মতো জীবন থেকে ঝরে যায়)। সত্যিকার অর্থে পারিপার্শ্বিক অবস্থা, আমাদের চারপাশের পরিচিত মানুষ, মানুষের ভালো লাগা, মানুষের অনুভূতি, মানুষের চাওয়া-পাওয়া দিনকে দিন বদলে যায়। বদলে যায় মানে সুন্দর।
বদলে যাওয়ার কথা যখন বলছি- তখন বলতে হয়, আমাদের এখন বিসিএস ক্যাডার হতে হবে। যে ছেলেটা জানে, তার মেধা ও পরিশ্রমের মানসিকতা সবমিলিয়ে তার পরীক্ষা বিসিএস ক্যাডার সম্ভব হবে না, সেও বিসিএস বিসিএস করে চিন্তায় দুনিয়া উজাড় করে ফেলে। বিসিএস ক্যাডার মানে সরকারী চাকুরি। আমাদের দেশে সরকারী চাকুরি পাওয়া মানে এটা নিশ্চিত- একজীবনে এই চাকুরি চলে যাওয়ার চান্স কম বা নাই। পাত্রীপক্ষ এরকম জামাই খুব পছন্দ করে। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে একটা ভাব চলে আসে। আর ফেসবুক তো আছে, আপনাকে শুভেচ্ছা জানাবে, অভিনন্দন দেবে।
আপনার কাছে সুন্দর সুন্দর টিপসের জন্য সুন্দরীরা আসবে। রীতিমতো এলাহি কাণ্ড। কেন বর্তমান প্রজন্ম বিসিএস ক্যাডার হতে চাচ্ছে এবং এটা হতে না পারলে জীবন ১৪ আনা মিছা বলে ধরে নিচ্ছে, তার পিছনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনেক কারণ রয়েছে। এ বিষয়ে সুযোগ পেলে বিস্তারিত পরে লিখবো, এখন আমরা আমাদের মূল বিষয়- কেন আপনি শুধু শুধু উদ্যোক্তা হতে যাবেন না, এটা আলোচনা করি।
একজন উদ্যোক্তা- যাকে আমি খুব সহজ করে বলি নিজের জন্য, নিজের সংসার খরচ মেটানোর জন্য বা নিজের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে একটু ভালোভাবে রাখার জন্য, যে নিজের কাজ নিজে করে এবং নিজে পরিশ্রম করেন, যার কাছে কোন মূলধন নেই, যার বাবা ব্যবসার জন্য দু’পয়সা দিবে না, যার দু হাতে দুইটা ডাবল জিরো, নিজে নিজের জন্য দিনরাত খাটেন। বড় উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী আলাদা জিনিস।
এই বইতে তাদের জন্য তাদের জন্য কিছুই নেই। এই বইতে আছে তাদের জন্য একরাশ দুঃখ। দুঃখ হলো কম টাকায় যেসব কর্মচারী আছে, তারা এই বই পড়লে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে নিজের প্যাশনকে ভালোবেসে নিজে উদ্যোক্তা হয়ে যাবে এবং নিজের একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে।
এবার আসুন আসল কথায় আসি, কেন আপনি শুধু শুধু উদ্যোক্তা হতে যাবেন না। বর্তমানে একটা ট্রেন্ড চলছে, উদ্যোক্তার ট্রেড। চাকুরি পাচ্ছেন না, পকেট ভর্তি ভিজিটিং কার্ড। বাসা ভাড়া, মেস ভাড়া বকেয়া, গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন করেন বাবা মা, রিসিভ করে আপনি কি নিয়ে কথা বলবেন- তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন! আপনি শুরু করে দিলেন- কিছু একটা। ফেসবুকে একটা পেইজ খুললেন, সমানে বন্ধুবান্ধবদের ইনভাইট পাঠালেন।
কেউ কেউ লাইক দিল, কেউ কেউ পিছনে আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করলো। আপনি আপনার ফেসবুকের টাইমলাইনে মোটিভেশন লাইন কয়েকটা কপি/পেস্ট মেরে দিলেন। দুই/ চারটা প্রোডাক্ট সেল করলেন। অর্ডারের যে অগ্রীম টাকা পাঠিয়েছে, দেখা গেল খরচ হয়ে গেছে সে টাকা। আপনি প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিলেন না, ফেসুবক ডিএক্টিভ করে লম্বা ঘুম দিলেন।
তিন চার বন্ধু একসাথে কিছু একটা শুরু করলেন। সপ্তাহখানিক যেতে এক বন্ধু আপনাদের সাথে আর নেই। আপনারা বাকি দুজন দৌড়াদৌড়ি শুরু করলেন। অনুপ্রেরণার গল্প পড়লেন। ইউটিউবে বিখ্যাত ব্যক্তির কষ্টের গল্প শুনে, নিজে নিজে অনুপ্রাণিত হতে লাগলেন। মাস খানিক নিজেকে কষ্ট করে বুঝালেন, ধৈর্য ধরতে হবে। ধৈর্য ধরতে ধরতে দু মাস চলে গেল। সেল বাড়লো না। বা বলার মতো সেল নেই। এরইমধ্যে ধারদেনা করে ৫/১০ হাজার খরচ করলেন। কিন্তু কাজের কাজ যেটা হওয়ার কথা, সেটা হয়নি। আপনি ধৈর্যকে হারিয়ে দিলেন। ছেড়ে দিলেন- কিছু একটা। এখন?
এখন একদিকে আপনি চরম হতাশ হলেন অন্যদিকে আপনার চাকুরি বা নতুনভাবে কিছু করার যে উদ্যম- তা হারিয়ে গেছে। আপনাকে দেখে পাশের ছোট ভাই-বোন তারাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। এই যখন অবস্থা- তখন ধারাভাষ্য বিরতি। আসছে- আগের মতো ছন্নছাড়া জীবন! তাই শুরুতে আমি আপনাকে বলছি, আপনি উদ্যোক্তা হবেন- এই চিন্তা বাদ দিয়ে ভালো হয়, চাকুরি করেন। বেতন অল্পস্বল্প হোক, জীবন চলে যাবে।
পরবর্তীতে ভালো কোথাও চাকুরি পেলে, চাকুরি পরিবর্তন করতে পারবেন। কিংবা সরকারি চাকুরির জন্য চেষ্টা করুন। আপনাকে দিয়ে হবে। সবাই সব কাজের জন্য না। আবার সবাই কিছু না কিছু করবে, আপনাকে যেহেতু সৃষ্টিকর্তা দুনিয়াতে পাঠিয়েছে, আপনার জন্যেও নিশ্চয় ভালো কিছু আছে। খুঁজে নিন, কাজে নেমে পড়ুন। খুঁজতে সময় লাগবে কিন্তু নিজের পছন্দের কাজটা পেলে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না।
আজ থেকে দশ বছর আগে বাংলাদেশে একটা বিপ্লব হয়েছিল। বিপ্লব বললে আমরা যুদ্ধ, হানাহানি, রক্ত এসব বুঝি! এই বিপ্লব ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা ক্লাসে না গিয়ে শপিংমল বা এসি রুমে চলে আসত। ক্লাস রুমের পরিবর্তে তাদের কাছে ট্রেনিং হল রুম ছিল খুব প্রিয়। সেই হল রুমের কথা বলার আগে ক্লাস সিক্সে আমার শ্রদ্ধেয় এক শিক্ষকের একটি জোকস শোনাতে মন আঁকু-পাঁকু করছে।
স্যার বলছিলেন- তোমরা কি নগদে পয়সা কামাতে চাও নাকি বাকিতে? আমরা ঐ বয়সে প্রশ্নের আগামাথা বুঝিনি। স্যার ব্যাখ্যা করছিলেন এভাবে- নগদ ইনকাম মানে কারখানা বা গ্যারেজে কাজ শিখে নাও, ৬/৭ মাস পরে মহাজন তোমাকে মাসে মাসে খাওয়াবে আবার মাসে তিন-চার হাজার টাকা দেবেন। বছর যেতে না যেতে কাজে দক্ষ হবে, বেতন বাড়বে।
ক্লাস সিক্সে আমরা ৮৬ জন ছাত্রছাত্রী ছিলাম। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি- মাত্র পাঁচজন। ভাবা যায়? বাকীরা নগদ ইনকামে চলে গেছে। আমরা কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে কেউ বিয়ে করেছে, কেউ কেউ বাচ্চাকাচ্চার নিয়ে বেশ ভাল আছেন। যারা পড়ালেখা করেছে, তাদের মধ্যে একজন সচিব, এক বন্ধু বিমানবাহিনীতে ইঞ্জিনিয়ার, একজন শিক্ষকতা করেন, আরেকজন ডাক্তার এবং আমি অধম আপনাদের জন্য বই লিখছি। মোরাল অব দ্যা স্টোরি হচ্ছে, সফলতা ব্যর্থতা বলে কিছু নেই।
আমি আমার সেইসব ঝরে পড়া বন্ধুদের যথেষ্ট সম্মান করছি। সবাই ভালো আছে বা ভালো থাকার চেষ্টা করছে। এটা মোটামুটি সবার পরিচিত চিত্র। কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন- ভাল একটা চাকুরি হবে বা অনেক পয়সাকড়ি আয় হবে, এটার জন্য লেখাপড়া না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, আমি যেসব নতুন বন্ধু পেয়েছি, যত জায়গায় ঘুরেছি, যত মানুষ দেখেছি, যত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, বিচিত্র সম্পর্ক বা নানা রকম বই পড়া থেকে যে আনন্দ পেয়েছি- তা আমার ঐ বন্ধুরা হয়তো মিস করেছে। এবার আসি হলরুমের গল্পে।
আজ থেকে দশ বছর আগের বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে হঠাৎ যে পরিবর্তন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়াতে আলোড়ন তৈরী করেছিল। সবাই নগদ ইনকামে ঝুঁকে পড়ছে, ক্লাস রুম ফাঁকা। বন্ধুদের মধ্যে আড্ডা দেওয়ার সময় নেই। কোথাও দাঁড়িয়ে গল্প করার সময় কই, সবার চোখে শুধু টাকা আর সফলতা।
যাদের একটু বয়স হয়েছে, তারা টাকা দ্বিগুণ করার স্বপ্নে বিভোর, আর যারা তরুণ তারা স্মার্ট এবং কম পরিশ্রমে সফলতা চাচ্ছে এবং মাঝামাঝি বয়সী যুবকেরা তরুণ বয়সের ব্যর্থতা পুষিয়ে দিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিলেন। কোন উৎপাদন নেই, কোন দক্ষতা নেই, কোন কাজ নেই। শুধু মুখের চাপার জোরে একেকজন মানুষ অন্য একজন মানুষের পকেট থেকে ক্যাশ টাকা বের করার ধান্দা করেছিল।
ডান হাত, বাম হাত; ঘুরেফিরে এক হাত। কেউ পিএইচডি করছে, কেউ ডায়মন্ড হচ্ছে, কেউ ট্রেইনার কিন্তু ভিতরে সবার ফাঁকা। শুধুমাত্র মুখের চাপার জোরেপুরোপুরি ঝুঁকিতে ফেলে দিবেন না। আপনি আরেকজনের কাছে একটা সংখ্যা মাত্র, সে আপনাকে দেখিয়ে দশ হাজার, একলক্ষ সদস্যের বড় সংখ্যা প্রচার করবে। আপনি বুঝে না বুঝে, নদীতে ঝাঁপ দিবেন। এদিক-সেদিক থেকে বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা জোগাড় করে, ইনভেস্ট করবেন- দিনশেষে ইউ আর লুজার।
পরিশেষে—আপনার যদি রোদ সহ্য না হয়, বৃষ্টিতে জ্বর আসে, হাঁটলে পায়ে ব্যথা করে, অপেক্ষা করলে বিরক্তি আসে, ধৈর্য ধরতে বললে তাকে মারতে ইচ্ছা করে, পকেট ফাঁকা থাকার চেয়ে আত্মসম্মান বেশি হয়, নগদে বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা থাকে, বন্ধুদের একটু আধটু টিটকারী সহ্য করতে না পারেন, কাজের চেয়ে অলসতা বেশি উপভোগ করেন, সততার চেয়ে মানুষ ঠকিয়ে বেশি আনন্দ লাভ করেন; তাহলে প্লিজ, আপনি উদ্যোক্তা হতে যাবেন না।
আপনি অন্যকিছু করুন, চাকুরি করুন, বাবার ব্যবসা করুন, ফুটবল খেলুন, আড্ডা দিন, বন্ধুদের মজমায় জোকস বলুন কিন্তু উদ্যোক্তা নামের যে বিষবাষ্প তার আশপাশেও ভিড়বেন না। আপনার জন্য অজস্র শুভকামনা। সুন্দর হোক আপনার আগামী। আর হ্যাঁ, এই বইটিও আপনাকে কষ্ট করে আর পড়ার প্রয়োজন নেই।
আর যদি মনে হয়- না, আপনাকে আপনার কাজ খুঁজে নিতে হবে। কোন শর্টকার্ট পথে বড়লোক বা সফল হওয়ার ধান্দা নেই। পুঁজি কম, মনোবল আছে, পরিশ্রম করতে পারবেন এবং সর্বোপরি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো ছাড়া হাল ছেড়ে দিবেন না।
0 জন কমেন্ট করেছেন
দয়া করে কমেন্ট নীতিমালা পড়ুন